Sunday, July 1, 2012

বিশ্বায়নের যুগে আমার ডাল রান্না

 
পাওয়া আর না পাওয়া মিলিয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের জন্ম তারিখটি ছিল আজ।

দু’দিন আগেই ভুলে পাঠানো প্রিয়জনদের শুভেচ্ছা... ব্যতিক্রমী অসামাজিক এক ছায়াসঙ্গীর ফোন কল... প্রিয়জনদের আদর ভালবাসার লেখনীতে ভরে ওঠা ফেসবুক ওয়াল... বিকেলে ছোট মামনিটির নিয়ে আসা কেক... মোমহীন মোমদানি... আত্মীয় পরিজনের আদর ভালবাসা... আরও অসংখ্য টুকরো টুকরো ঘটনা আজকের এই দিনটিকে করে তুলেছিল বর্ণীল।

ফুরফুরে মেজাজে প্রতিদিনকার মত আজও অবসরে ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করছিলাম। পাশাপাশি চ্যাট করছিলাম অষ্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বাঙ্গালী এক বন্ধুর সাথে। মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল রাতের খাবারের চিন্তা।

আজ মুশুরির ডাল খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। আমি রান্না করার কাজটি অতি সম্প্রতি শিখেছি। চোখের সামনে রেসিপিটি ধরা না থাকলে কোন রান্না করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না আমার।

আজই প্রথম বাগার দিয়ে মুশুরির ডাল রান্না করার উদ্দেশ্যে কম্পিউটারে রক্ষিত রেসিপির ফাইলটি খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু কোনক্রমেই ফাইলটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

রেসিপি ফাইলটি না পেলে তো আমার হাত পা বাঁধা... রান্না করব কিভাবে!

চিন্তা করলাম বাংলাদেশে ফোন করব মায়ের কাছে... ডাল রান্নার কায়দা কানুন জানার জন্য। কিন্তু সময়ের হিসেবে দেখলাম বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী এখন অনেক রাত। মা ঘুমিয়ে পড়েছে।

চ্যাটরত অপরপ্রান্তের বন্ধুটি জানায়... সে বিরক্ত আমার উপর... কারণ আমি সমতালে চ্যাট করছি না... উত্তর দিতে দেরী করছি আমি...

আমি তাকে জানালাম রান্না করব কিন্তু রেসিপির ফাইলটি খুঁজে পাচ্ছি না।

বন্ধুটি বলল অষ্ট্রেলিয়ায় তোমার স্ত্রীকে ফোন কর...

আমি তাকে জানালাম... স্ত্রীকে ফোন করলে সোজা বলবে “তোমার রান্নার দরকার নেই... পিজ্জা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়”। ব্যস... আমার আর ডাল খাওয়া হবে না।

বন্ধুটি বলল তাহলে ইণ্টারনেটে সার্চ কর... রেসিপি পেয়ে যাবে।

ওকে বললাম "গুড আইডিয়া"... তোমার সাথে চ্যাট শেষ করে রেসিপি খুঁজব।

বন্ধুটি জানতে চাইল আজকের রান্নার আইটেম কি..."? কি রান্নার জন্য রেসিপি খুঁজছ?

আমি বললাম ডাল?

এই কথা শুনে বন্ধুটি বলল ডাল রান্না তো খুবই সোজা... অপেক্ষা কর... আমি তোমাকে লিখে দিচ্ছি কিভাবে ডাল রান্না করতে হয়...

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাল রান্নার রেসিপিটি পাঠিয়ে বন্ধুটি জিজ্ঞেস করল... তুমি পারবে তো রান্না করতে?

আমি সগর্বে বললাম... পারবো না মানে (!)... প্যারিসে বসে রান্না করব... তুমি অষ্ট্রেলিয়ায় বসে এর সুগন্ধ পাবে...

আমি মহা আনন্দে ডাল রান্নার উদ্দেশ্যে রান্না ঘরে গেলাম... কিন্তু সমস্যা হল রান্নাঘরে গিয়ে তো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না...

ওহ! আপনাদেরকে বলা হয়নি। আমি ফ্রান্সে বসবাসরত আমার বড়বোনের বাসার রান্নাঘরের কথা বলছি।

বড় বোন জরুরি কাজে কানাডা গিয়েছে গতকাল।

ঘরে আর কেউ না থাকাতে রেসিপি পাওয়া সত্ত্বেও আমি কিছুই করতে পারছিলাম না।

সময় হিসাব করে দেখলাম এখন কানাডায় ফোন করলে বোনকে পাওয়া যাবে। ফোন করব করব ভাবছি... ঠিক সেই মুহূর্তে কানাডা থেকে বড় বোনের ফোন এল। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

হলুদ, মরিচ, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, লবণ... সবকিছুর খোঁজ নিলাম।

বন্ধুটির দেওয়া রেসিপি অনুযায়ী মহাসমারোহে শুরু করলাম ডাল রান্না।

কল্পনায় বার বার ভেসে উঠছিল... ছোটবেলায় মায়ের পাশে বসে দেখা ডাল রান্নার প্রতিটি ধাপ। বন্ধুটির দেওয়া রেসিপির সাথে আমার মায়ের ডাল রান্নার প্রতিটি ধাপের আশ্চর্য একটি মিল রয়েছে।

বিশেষ করে ডাল বাগার দেওয়ার আগের এবং পরের ধাপ গুলো যখন সম্পন্ন করছিলাম মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল।

পরিবর্তনের এই যুগে সবকিছু পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত... কিন্তু স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে ডাল রান্নার ত্রিশ বছর আগের যে পদ্ধতি দেখেছিলাম এখনো সেই একই রয়ে গেছে...

ডাল রান্না করার ফাঁকে দু’একবার ফেসবুকেও উঁকি দিয়ে গেলাম। দেখলাম... এক বাংলাদেশী বান্ধবী বাংলাদেশে বসে ইউরো কাপ দেখছে আর ক্ষিস্তি খেউর করে স্ট্যাটাস দিচ্ছে... আমি ফুটবল পাগল মানুষ... অথচ ইউরোপে বসে ইউরো কাপ এর কথা বেমালুম ভুলে গেছি... সাথে সাথে টেলিভিশন চালু করে দিলাম...

অষ্ট্রেলিয়া থেকে প্রাপ্ত রেসিপি... কানাডা থেকে পাওয়া সরঞ্জাম এর খোঁজ... আর কল্পনায় ভেসে ওঠা বাংলাদেশে দেখা আমার মায়ের ডাল রান্নার ধাপ গুলো মিলিয়ে... ফ্রান্সে অবস্থিত রান্নাঘরে বসে অবশেষে ডাল রান্না সম্পন্ন করলাম।

রান্নার পর ডালের চেহারাটি কিন্তু মন্দ দেখাচ্ছিল না!

এবার খাবার পালা। খেতে বসে দেখলাম সঠিক রেসিপি, ভেজাল মুক্ত উচ্চমানের সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও ডালের স্বাদটি যেন কেমন হয়েছে! ঠিক ডালের মত লাগছে না।

আমি খেতে পারছিলাম না...বুঝতেও পারছিলাম না... সমস্যাটি কোথায়...!

লবণ কি দিতে ভুলে গিয়েছি! নাকি কম দিয়েছি!... হলুদের গন্ধই বা এত প্রকট কেন!... আমি কি লবণ কম দিয়ে হলুদ দু’বার দিয়ে ফেলেছি!

আমার সাথে খেতে বসা স্থানীয় দুই বন্ধু ভাবল... এটাই বুঝি ডালের স্বাদ। কারণ বাংলাদেশী পদ্ধতিতে রান্না করা ডাল খেয়ে অভ্যস্ত নয় ওরা। ওরা ডাল খেয়ে আমার রান্নার তারিফ করছিল। আর আমি তা দেখে হাসছিলাম...

বাংলাদেশে যখন চাকুরি করেছি, তখন বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চবেতনের বিনিময়ে আগত অনেক বিশেষজ্ঞের সংস্পর্শে এসেছি... এদের মাঝে অনেকেই আসলে আমার মতই পাচক...

এদের কেউ কেউ নিজের দেশে ব্লক প্রিন্টিং এর কাজ করতে করতে... শুধুমাত্র চর্ম রং এবং বিশেষ কিছু দেশে জন্মগ্রহন করার সুবাদে... বাংলাদেশে গিয়ে... “জেন্ডার এক্সপার্ট”... আবার কেউ কেউ “রাজনৈতিক উপদেষ্টা”... হয়ে... দেশের বারোটা বাজাচ্ছে...

“এর কাছ থেকে রেসিপি”... “ওর কাছ থেকে খোঁজ খবর”... “অন্যদের করা কাজকে নতুন মোড়কে মুড়ে”...বিশেষভাবে-অনভিজ্ঞ এই বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ... সমস্যার প্রকৃত প্রকৃতি অনুধাবন না করেই... দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করে কিছু অখাদ্য পরামর্শ দিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত...

আমাদের দেশীয় উচ্চপদে আসীন কিছু অনভিজ্ঞ লোকজন... এই অখাদ্য খেয়ে বাহবা দিচ্ছে...

পরবর্তীতে বাংলাদেশেরই স্বল্পবেতনভোগী বিশেষজ্ঞদের ঘাড়ে এসে পড়ছে বিশেষভাবে-অজ্ঞদের তৈরি করা এই অখাদ্য গুলোকে হলুদ লবণ ঠিক করে কোনভাবে খাদ্য উপযোগী করে তোলার দায়িত্ব...

No comments:

Post a Comment

Thank you for your time. I will get back to you soon.
Nathan