Sunday, July 1, 2012

শূণ্য পূর্ণ অনুভূতি

চারিদিকে সবাই উন্নতি করছে, সাফল্য পাচ্ছে... নতুন উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে। ভাবতে ভালো লাগে, কারণ সঠিক পথে কেউ উন্নতি করলে বা সাফল্য লাভ করলে কার না ভালো লাগে। আর তাছাড়া এরা সবাই তো আমার কাছের মানুষ... আত্মীয়-স্বজন... গর্বে বুক ভরে ওঠে।

অনেক ক্ষেত্রে আত্মীয় না হলেও... দূরের কেউ হলেও... তাদের সাফল্য দেখে কাছের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাদের উচ্চতার উপর ভর করে নিজেদের উচ্চতা বাড়িয়ে নিতে সবসময় উদগ্রীব হয়ে থাকি।

আমি নিজেও সাফল্য লাভের আশায় রাতদিন ছুটে চলেছি। সাফল্য ধরাও দিচ্ছে একের পর এক। সামাজিক মর্যাদা, অর্থ-বিত্ত, গাড়ি-বাড়ি, সুন্দর সাজানো সংসার... বস্তুগত সাফল্য লাভ বলতে যা বোঝায় তার মোটামুটি সবই পেয়েছি...

আজকাল অনেককেই দেখি আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতে...
আসে... বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বিশেষ অতিথির পদ অলংকরণের নিমন্ত্রন...

অনেকে আবার আমাকে দেখলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়... অনেকে আবার বসতেও দেয়... অভ্যাসবশঃত বড়দের দেখলেই তাদের সম্মানার্থে যা করে থাকি আমরা।

কিন্তু যখন দেখি আমার চেয়ে দ্বিগুন বয়সের মানুষগুলোকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে... নিজের ঘাড়ের গামছা দিয়ে সযত্নে চেয়ারটি মুছে আমাকে বসতে দিতে... প্রশ্ন জাগে... এর অর্থ কি? এটা তো অভ্যাসবশঃত নয়?

এই জীবনে লেখাপড়া আর অর্থ আয় করা ছাড়া এমন তো কোন মঙ্গলজনক কাজ করি নি, যা এত সম্মান বয়ে আনতে পারে আমার জন্য।

তাহলে এই সম্মান দেখানো কেন?

আমার অর্থ-বিত্তের জোর? ক্ষমতার জোর?

যদি তাই হয়... তাহলে এর অর্থ হচ্ছে... তারা তো আমাকে সম্মান করছে না... করছে আমার অর্থ-বিত্ত আর আমার ক্ষমতাকে।

আর যে ক্ষমতার বড়াই করছি সেটাও তো ঐ চেয়ারের বদৌলতে।

যে গরীব মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশার কথা বলে ছবি দেখিয়ে... দাতাদের কাছ থেকে প্রচুর অঙ্কের অর্থ নিয়ে আসছি...

সেই গরীব মানুষগুলোই তাদের এলাকায় আমার পদার্পণ উপলক্ষে... আমি কিসে খুশী হবো... কিসে না হবো... কি খাব... কি না খাব... কোথায় থাকবো... এই
চিন্তাতে সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে...

অফিসের বড় কর্তা বলে কথা... পাছে কর্তা বেজাড় হয়ে গেলে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়...

তারা একবারও ভাবে না... এই আমি যার জন্য তারা এতো ব্যতিব্যস্ত... সত্যিকার অর্থে আমার দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো... শান শওকতের জীবন যাপন সবই তাদের বদৌলতে।

আজ যদি তারা গরীব না হতো... তাদের জন্য অর্থ সাহায্য না আসতো... আমার অর্থ-বিত্ত, গাড়ি-বাড়ি কিছুই হতো না।

দয়াপরবশ হয়ে অর্থ দিচ্ছে একজন... আরেকজনকে... আর মাঝখানে মজা লুটছি আমি।

এই ক্ষেত্রে আমার কাজটি তো অনেকটা বাজারের “মিন্তি”-র মত। অর্থ নিয়ে ঐ গরীব মানুষগুলোকে পৌঁছে দেয়া। এর বিনিময়ে মাসিক বেতন হিসেবে কিছু অর্থ পাওয়া।

টাকা বহন করা ছাড়া তো আর কিছুই নয়।

‘মিন্তি’ শব্দটা হয়তো অনেকের কাছেই অপরিচিত। ঢাকার বড় বড় বাজারে মিন্তিদের দেখা পাওয়া যায়। ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরা ঝাঁকা নিয়ে বসে থাকে। গাড়ির হর্ন বাজাতেই ওরা সচকিত হয়ে ওঠে। তারপর ঝাঁকা মাথায় করে ভোঁ দৌড়। সোজা সাহেব বা সাহেবার কাছে। বিনীত আবেদন ‘মিন্তি’ লাগবে স্যার। সাহেবের বাজার টানা বাবদ কিছু পায় শিশু ‘মিন্তি’।

কিন্তু এই বহন করা বাবদ আমি যা পাই তা তো অনেক! যাদের জন্য এই অর্থ তারা তো আমার তুলনায় কানাকড়িও পায় না।

আমার যে সম্পদ... সবই তো আসলে ঐ গরীব মানুষগুলোর অর্থ থেকে নেয়া... ওদের নামে অর্থ এনে বেশীর ভাগ অংশই বিভিন্ন খাতে হিসেবের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়া...

যাদের দুঃখ দুর্দশাকে পুঁজি করে আজ আমার এই অর্থ-বিত্ত, প্রতিপত্তি... সেই গরীব মানুষগুলোকেই আত্মীয় বা খুব কাছের বলে পরিচয় দিতে গিয়েও আজকাল দ্বিধান্বিত হয়ে পরি... ক্ষেত্রবিশেষে না চেনার ভান করি... পাছে অন্যদের সামনে নিজের উচ্চতা নেমে যায়...

মাঝে মাঝে শূণ্য পূর্ণ অনুভূত হয়...

যে গরীব মানুষগুলোর রস শুষে আজ আমার এই অবস্থানে আসা তাদের সঙ্গেই আজ সম্পর্ক ছিন্ন...

এত অর্থের মাঝেও আজ আমার জীবন অর্থহীন... ক্ষমতা হয়ে দাঁড়িয়েছে গলার কাঁটা...

আজকাল সব কিছুই কেমন যেন উল্টা-পাল্টা লাগে... অনেকটা পাগলা পাগলা...

No comments:

Post a Comment

Thank you for your time. I will get back to you soon.
Nathan