Sunday, July 1, 2012

মুখোশ

রায়হান... বয়স ত্রিশের কাছাকাছি...

নীপা আর দুই সন্তান লইয়া আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রনে ছোট্ট একটি পরিবার।

আদরের বড় মেয়েটির নাম রুমা... তৃতীয় শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। ছোটটি রনি... সবেমাত্র দু’পায়ের উপর ভর করিয়া অসীম বিস্ময়ে এই ভুবন অবলোকন শুরু করিয়াছে।

নীপা একজন শিক্ষিকা।

রায়হান একটু ভীতু প্রকৃতির। শিশুকাল হইতেই শান্তিপ্রিয় গোবেচারা ধরণের। কোন কিছুতেই আগ্রহ বেশীদিন স্থায়ীত্ব পায় না। নিজের মনে যখন যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই করিতে চায়।

শৈশবে একবার অভিপ্রায় হইয়াছিল... বিভিন্ন পণ্যের ফাঁকা কাগুজে প্যাকেট সংগ্রহ করিবার। বয়স আঠারো বছরের কম হওয়ায়, প্রাপ্তবয়স্ক পণ্যের প্যাকেট ব্যতিত, জামবাক হইতে শুরু করিয়া নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুটের ফাঁকা প্যাকেট সংগ্রহ করিয়া তাহার পড়ার টেবিলের নীচে একটি সংগ্রহশালা গড়িয়া তুলিয়াছিল।

ওর বন্ধুরা কেহ ডাকটিকেট সংগ্রহ করিত, কেহ কেহ আবার কয়েন সংগ্রহ করিত... নানবিধ শখ ছিল তাহাদের মাঝে। রায়হান প্যাকেট সংগ্রহ করিবার অভিপ্রায় বন্ধুদের মাঝে ব্যক্ত করিবার পর... সবাই একযোগে হাসিয়া উঠিয়াছিল। এই কারণে রায়হান তার সাধের ফাঁকা প্যাকেটের সংগ্রহশালাটি একটু আড়ালে আবডালেই গড়িয়া তুলিয়াছিল।

ফাঁকা কাগুজে প্যাকেট গুলোকে তাহার কাছে “মুখোশ” বলিয়া ভ্রম হইত...

জড় বস্তুকে মোড়কে আড়াল করিলে উহার নামকরণ হয় “প্যাকেট”। কিন্তু জীবন্ত “মুখ” কোন “জড়” বা “অদৃশ্য” মোড়কে আড়াল করিলে উহার নামকরণ হয় “মুখোশ”... আড়াল করাটাই মুখ্য...

রায়হান অবাক হইত প্যাকেটের আকার, নকশা, রংয়ের বাহার এবং চাকচিক্য দেখিয়া।

তাহার বোধ হইত প্যাকেটে গুলোর জন্মই হইয়াছে যাহাতে মানুষ ভ্রমে পড়ে, যাহাতে ইহার ভিতরের উপাদানটি না দেখিয়াই প্যাকেটের চাকচিক্যের ভ্রমে পড়িয়া কোন উচ্চ বাচ্য ব্যতীত খদ্দেরগণ পণ্যটি ক্রয় করিয়া লয়।

ভিতর স্থিত পণ্যটি উন্নত করার পরিবর্তে উপর স্থিত মোড়কটির চাকচিক্য বর্ধনই আসল উদ্দেশ্য। তৎসময়ে এডভারটাইজিং, মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং বিষয়ক জ্ঞানগুলো রায়হানের আয়ত্তে আসে নাই।

একদিন রায়হানের মা পড়ার টেবিলের নীচে ফাঁকা প্যাকেটের জংগল দেখিয়া ঝেঁটিয়ে বিদেয় করিয়া দিল। রায়হান স্কুল হইতে ফিরিয়া দেখিল তাহার শখের রংগিন “মুখোশ পৃথিবীটির” মৃত্যু ঘোষিত হইয়াছে।
...
...
...

রায়হান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকাইয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থায় চাকুরি করিতে শুরু করিল।

গোয়েন্দা সংস্থায় তাহার প্রধান কর্ম হইল, কম্পিউটার হইতে গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করিয়া তদন্ত কর্মে সহায়তা করা। রায়হান মেধাবী হওয়ায় অল্পদিনেই এই কর্মে পারদর্শী হইয়া উঠিল।

ইমেইল আদান প্রদানের তথ্য...চ্যাটিং এর তথ্য... ফেসবুক এর তথ্য... টুইটারের তথ্য... সংস্থা সম্পর্কিত তথ্য... ব্যক্তিগত তথ্য... প্রেম... ভালবাসা... নৈতিক... অনৈতিক... হত্যা... গুম... আরও বহু বিষয়...

জটিল সব কর্ম অনায়াসে সম্পাদন করিবার অদ্ভুত এক ক্ষমতা থাকায় সহকর্মীরা তাহাকে ঈর্ষার চোখে দেখা শুরু করিল।

রায়হান এই কর্মে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করিত বলিয়া প্রায়শঃই নীপার বকুনি হজম করিতে হয়। তাহার কাছে গোপনীয় তথ্য উদঘাটনের এই কর্মটি অনেকটা নেশার মতই হইয়া গিয়াছে।

রায়হানের কর্ম মূলতঃ কাহারও ব্যক্তিগত পাসওয়ার্ড উদ্ধার করিয়া তাহার কম্পিউটারে প্রবেশ করা। এর পরবর্তী কর্ম গুলো তাহার সহকর্মীরা সম্পাদন করে।

রায়হান লক্ষ্য করে... প্রায়শঃই উদ্ধারকৃত গোপন তথ্যের সহিত বাস্তব জগতের মানুষটির বৈপরীত্য আকাশচুম্বী। মাঝে মাঝে ইহা বিশ্বাস করিতে হিমশিম খাইতে হয়। নিজেদের কাছেই নিজেদেরকে মিথ্যাবাদী বলিয়া বোধ হয়।

এই মানুষগুলির মুখ অদৃশ্য মুখোশে আবৃত... তাহাতে প্রতারণার এত রং, মিথ্যে অভিনয়ের এত চরিত্র... ভালমানুষির মুখোশে কথার চাতুর্যতায় এত লোকদেখানো চাকচিক্য... যে তাহাদের আসল রূপটি আমজনতা ধরিতে পারে না। উহারা সমাজ এবং দেশের উচ্চ আসনে আসীন।

এদের প্রতারণার খপ্পরে পড়িয়া জনতার নাভিশ্বাস উঠিয়া যাইতেছে। তাহাদের দুর্নীতিতে অক্ষয়ও ক্ষয়ে শেষ হইয়া যাইতেছে।

নিজেদের সুখ ক্রয় করিতে গিয়া, উহারা অপরের সুখ বিক্রয় করিতেও কুন্ঠাবোধ করিতেছে না।

রায়হানের প্রায়শঃই মনে পড়ে তাহার শৈশবের সেই "রংগিন মুখোশ পৃথিবীটির" কথা।

কিন্তু আফসোস... তাহার মায়ের মত এমন কেহই নাই যে এই মুখোশ পড়া মানুষ গুলোর মুখোশ খুলিয়া দিতে পারে... ঝেঁটিয়ে বিদায় করিয়া দিতে পারে আড়ালে লুকাইয়া থাকা সমস্ত মিথ্যে অভিনয়ের জাল...

নীপার বকুনি আর দীর্ঘশ্বাস নিত্যসঙ্গী করিয়াই রায়হানের জীবন এগিয়ে চলে।

No comments:

Post a Comment

Thank you for your time. I will get back to you soon.
Nathan