Tuesday, May 1, 2012

স্বর্গেও সুখ নেই...!


আমি এর আগেও ফ্রান্সে বেড়াতে এসেছি। সময় স্বল্পতার কারণে ফ্রান্সে অবস্থানকারি বাংলাদেশীদের অবস্থা সম্পর্কে জানার এবং বোঝার সুযোগ ছিল কম। কিন্তু এইবার বেশী সময় নিয়ে এসেছি তাই জানার সুযোগও বেশী পাচ্ছি।

যতই আমি জানার চেষ্টা করছি আমার চিন্তা ধারা এবং আশা আকাংখার মাঝে এক অদ্ভুত ধরনের পরিবর্তন অনুভব করছি, যা কোন কোন সময় ইতিবাচক আবার কোন কোন সময় নেতিবাচক।   

প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি।

প্রত্যক্ষ নিরীক্ষণ ও পরোক্ষ পর্যবেক্ষণ এর মাধ্যমে এখানে বাংলাদেশীদের দুই ধরনের জীবন যাপন পরিলক্ষিত হয়। স্বঘোষিত স্বর্গ বাসি এবং স্বঘোষিত নরক বাসি।

যারা এখানে সাফল্যের সাথে (আইনগতভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত) বসবাস করছেন তাদের সাথে যখন কথা বলি তখন মনে হয়, আমি মৃত্যুর আগেই স্বর্গবাস কাকে বলে তার গল্প স্বর্গে বসবাসকারি একজন মানুষের কাছ থেকে  শুনছি। 
মানুষটি যে স্বর্গসুখে আছে তা শুধু তার কথায় নয়, তার ব্যবহার, অংগ ভংগি, আচার আচরন, এমনকি কথা বলার সময় চোখের নাচনে তা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।  

আমি জানি না মৃত্যুর পর আমার স্বর্গ বাস হবে কিনা, তবে এটাই কম কিসে, অন্তত কিছু সময়ের জন্য একজন স্বর্গ বাসির সান্নিধ্য তো লাভ করলাম।

তাই আরো বেশী সময় স্বর্গ বাসিদের সান্নিধ্য লাভের লোভে আমিও বিভিন্ন ওজুহাতে অথবা প্রশ্ন করে তাদের সান্নিধ্যে থাকার এবং স্বর্গ  সম্পর্কে অনেক কিছু জানার চেষ্টা করি।

এই স্বঘোষিত স্বর্গ বাসিদের বক্তব্যে একটি লাইন গানের অন্তরার মত বার বার উচ্চারিত হয়...

“ভাই এখানে থেকে যান...যদি স্বর্গ সুখ পেতে চান” ।

অপরদিকে এখানে আরও এক ধরনের মানুষ রয়েছেন, যারা এখনও সাফল্যের মুখ দেখেননি, এর অর্থ হচ্ছে আইনগতভাবে থাকার অনুমতিপ্রাপ্ত হননি। অন্যকথায় স্বর্গের দেখা এখনও পান নি।

এদের মাঝে কেউ কেউ ১২ বছর আবার কেউ কেউ ১৪ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন স্বর্গ দ্বারে প্রবেশ করার জন্য। অনেকে আবার ১২/১৪ বছর অমানুষিক শারিরীক এবং মানসিক কষ্ট করার  পর জানতে পেরেছেন যে তাদের স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করার আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে, তার অর্থ হচ্ছে স্বর্গে প্রবেশ করার জন্য তিনি যে আবেদনটি করেছিলেন তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।

নরক বাসি বেশীর ভাগ মানুষই স্বর্গলাভের আশায় নিজের সব সহায় সম্পদ বিক্রি করে বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে জীবন বাজি রেখে ১২/১৪ বছর আগে এখানে এসেছেন। এই ১২/১৪ বছরের অভিজ্ঞতায় তাদের বক্তব্য হচ্ছে "ফ্রান্সে বসবাস করা আর নরকে থাকা, একই সমান"। এই স্বঘোষিত নরক বাসিদের বক্তব্যে কিছু লাইন বার বার উচ্চারিত হয়...

“ভাই মরলেও এইখানে থাইকেন না...নরকও এর চাইতে ভাল... দেশে চইলা যান... এরা মানুষ কে মানুষ হিসাবে গণ্য করে না”।

উপরের বিপরীতধর্মী চিত্র দুটি কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বিদেশ বিঁভুয়ে বাংলাদেশীরা এই ধরনের সুখ এবং দুঃখের মধ্য দিয়েই তাদের জীবন অতিবাহিত করছেন।

আমি এর আগেও বিভিন্ন দেশে ভ্রমনের সময় এই স্বর্গ বাসি এবং  নরক বাসি দু’ধরনের মানুষেরই জীবন যাপন খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি।

এখানে উল্লেখ্য যে, অন্যান্য দেশে বসবাসের ক্ষেত্রে যে ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় তার সাথে ফ্রান্সে বসবাসকারিদের সমস্যার বিস্তর ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়।

ফ্রান্সে স্বর্গ এবং নরক বাসিদের মধ্যে যে সমস্যাটি অত্যন্ত প্রকট, তা হচ্ছে "ফরাসী ভাষা"। অন্যান্য দেশে বাংলাদেশীরা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে তাদের কাজ চালিয়ে নিতে পারে।

কিন্তু ফ্রান্সে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার খুবই কম। তাছাড়া ফরাসী ভাষা আয়ত্বে আনা খুবই কঠিন। এখানে অনেকেই আপ্রাণ চেষ্টার পর এই ভাষাকে আয়ত্তে আনতে পারলেও, বেশিরভাগই সাফল্যের দেখা পান না।

এখানে নরক বাসিদের জন্য কাজ বা চাকুরি করা খুবই কঠিন একটি বিষয়। কারণ স্বর্গ বাসি হওয়ার আইনগত অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে তাদের পদচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অনুমতি না দেওয়ার কারণ টি হল... বেশীরভাগ নরক বাসি অবৈধ ভাবে এই দেশে প্রবেশ করে স্বর্গ প্রবেশের টিকিট এর জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।

স্বর্গ বাসি বাংলাদেশীদের কাজ বা চাকুরি করার আইনগত অধিকার রয়েছে। তারপরও বেশীর ভাগ বাংলাদেশী বোবার স্বর্গে কাজ করতে বেশী পছন্দ করেন।

ফরাসী ভাষা বলতে বা লিখতে না পারার কারণে এখানে বেশীরভাগ বাংলাদেশীদের কর্মক্ষেত্র হিসাবে প্রথম এবং প্রধান পছন্দ হল, যেখানে কাজ করার সময় কোন কথা বলার প্রয়োজন হয় না তার অর্থ ফরাসী ভাষা বলার এবং লেখার প্রয়োজন নেই। আড্ডা প্রিয় বাঙ্গালীর বোবা জীবন যাপন যে কতটা কষ্টকর তা সহজেই অনুমেয়। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে।   

নরক বাসিদের দুঃখ কষ্টের গল্প শুনিয়ে আপনাদের মন বিষণ্ণ করে তোলার অভিপ্রায় আমার নেই। তাদের জীবন সংগ্রামের করুন ঘটনা গুলো বিভিন্ন পত্র পত্রিকা মারফত অবগত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আপনাদের সবারই রয়েছে। 


স্বর্গ বাসের টিকিট পাওয়া একটি পরিবারের কথা বলে আমার লেখাটি শেষ করব।

আমি ফ্রান্সে আসার পর এখানে বসবাসকারি আমার বড় বোনের মাধ্যমে একটি পরিবারের সাথে আমার পরিচয় হয়। স্বামী, স্ত্রী এবং চৌদ্দ বছর বয়সি একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ছোট একটি পরিবার।

পরিচয়ের সুবাদে বেশ কয়েকবার তাদের গৃহে যাওয়ার এবং দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার সুযোগ আমার হয়েছে। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই অমায়িক এবং পরোপকারি। তাদের দু’জনকে অনেক বিশেষণেই বিশেষায়িত করার মত যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এখানকার জীবন যাপনের মানদণ্ডে বিচার করলে বেশ ভালোই আছেন তারা।

কিন্তু এই এতকিছু পাওয়ার মাঝেও কিছু না পাওয়া নিত্য তাদের পীড়িত করে। সময়ের পরিক্রমায় আমি জানতে পারলাম এই স্বর্গবাসেও তাদের সুখ নেই।

খুব সংক্ষেপে বলি।

ভদ্রলোক বাইশ বছর পূর্বে ফ্রান্সে অবতরন করেছিলেন। এরপর বিয়ে করে তার স্ত্রীকেও এদেশে নিয়ে আসেন। তাদের একমাত্র ছেলেটি এই দেশেই জন্মগ্রহন করেছে।

ছেলেটি ইতিমধ্যে এই দেশের আলো, বাতাস এবং শিক্ষায় ১৪ টি বছর পার করেছে।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেটির মা বাবা তাদের সাধ্যের মধ্যে ছেলের সব আবদারই পূরন করার চেষ্টা করেছেন।  কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ছেলেটি মা বাবার সাথে খুব অল্প কথা বলে।

এমন নয় যে, মা বাবার উপর তার কোন অভিমান থেকে সে এটা করে। এমন নয় যে, সে বাংলা ভাষা বলতে পারে না। এমনও নয় যে, সবার সাথেই সে কম কথা বলে। দেখা গেছে যে অনেকের সাথেই সে ফোনে বা সরাসরি দীর্ঘ সময় কথা বলে।

তার মা বাবাকে এই ব্যাপারটি প্রচন্ড পীড়া দেয়। সব সময় এক চাপা কান্না অনুভব করেন তারা দু'জনেই। কেন সন্তান তাদের সাথে খুব একটা কথা বলে না? এই প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায় তারা বেশ কয়েকবার ডাক্তারের শরনাপন্নও হন। কিন্তু কোন কিছুতেই কোন লাভ হয় নি।

অবশেষে বোঝা গেল মূল সমস্যা কোথায়...

ছেলেটি ফরাসী আলো, বাতাস এবং শিক্ষায় বৃদ্ধি লাভের কারণে সে ফরাসী ভাষায় পারদর্শী। ঘরে সে কিছু কিছু বাংলা শিখেছে। আর ইংরেজি ভাষা নিয়ে এখানে কারও মাথা ব্যথা নেই।

অপরদিকে তার মা বাবা বাংলায় পারদর্শী। মা গৃহিনী হওয়াতে ফরাসী ভাষাটি এখনও তেমন আয়ত্বে আনতে পারেন নি। আর বাবার কর্মক্ষেত্রের ধরণটাই এমন যে ফরাসী ভাষার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। তাই ফরাসী ভাষায় তার দখলও আহামরি কিছু নয়।

ছেলেটির মূল সমস্যা হল, বাংলাভাষায় মনের ভাব প্রকাশ  করার মত যথেষ্ট দখল বাংলাভাষার উপর তার নেই। তাই সে ফরাসী ভাষায় মনের ভাব প্রকাশে স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু তার মা এবং  বাবা দু’জনেই ফরাসী ভাষাতে দূর্বল হওয়ার কারণে ছেলের কথা প্রায় সময়ই ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারেন না।

এই সমস্যা ধীরে ধীরে তীব্র আকার ধারণ করে।     

ছেলেটি যতই বড় হতে থাকে মা বাবার সাথে তার কথা বলার পরিমান ততই কমে যায়। এখন এমন অবস্থা যে, মা বাবা নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস না করলে, ছেলেটি সারাদিন গৃহে থাকলেও বাবা মার সাথে নিজের আগ্রহে সাধারণত কোন কথা কথা বলে না। 

ভাষাগত দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে একটি মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়েছে তাদের মাঝে।
এই সমস্যাটি বুঝতে তার মা বাবার সময় লেগেছে প্রায় ১৪ বছর। কোন সমস্যা সমাধানকল্পে যত বিলম্ব হয় তত এর শাখা প্রশাখা বিস্তৃতি লাভ করে এবং সমাধান জটিল থেকে জটিলতর হয়। প্রথমে দিকে এই সমস্যাটি চিহ্নিত করা গেলে হয়ত সমাধানটা আরও সহজ হত।   
শুধুমাত্র ভাষাগত সমস্যার কারণে একই ছাদের নিচে থেকেও একজন মায়ের, একজন বাবার এবং একজন ছেলের মনের ভাব বিনিময় না করতে পারার এই যে চাপা দুঃখ তা অনুভব করা আমার মত অনুভুতিহীন বোহেমিয়ান জীবন যাপনে অভ্যস্ত  মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটা বুঝতে পারি স্বঘোষীত স্বর্গ বাসেও প্রকৃতপক্ষে স্বর্গ সুখের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

পার্থিব স্বর্গ সুখ চাই না। সন্তানের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে চাই।

নিজের স্বার্থে অন্ধ এবং ব্যস্ত না থেকে সন্তানের সাথে বেশী করে কথা বলুন এবং তাকে অন্যদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিন।   

No comments:

Post a Comment

Thank you for your time. I will get back to you soon.
Nathan