প্রত্যেক মানুষেরই জীবন সাধারনত আনন্দ, বেদনা এবং লজ্জা এই তিন ধরনের অনুভুতি নিয়ে আবর্তিত হয়। আমার জীবনেও কিছু ঘটনা যেমন ছিল আনন্দের, কিছু দুঃখের আর কিছু ছিল লজ্জার।
ওহ! আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হল না। আমার বাবা আমাকে আদর করে মেঘ বালিকা বলে ডাকতেন। আমি এই নামে বাবার ডাকে শেষবার সাড়া দিয়েছিলাম আজ থেকে কুড়ি বছর আগে।
আপনারা হয়ত ভাবছেন এরপর এমন কি ঘটনা ঘটল যে এই ডাকটি শোনার সৌভাগ্য আমার আর কেন হল না? আমার বাবাই শুধু এই নামে আমাকে ডাকতেন, তাই বাবার অবর্তমানে কে এই নামে আমাকে ডাকবে বলুন?
না আমার বাবা মারা যান নি। বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। এই ৬০ বছর বয়সেও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এইতো কিছুক্ষন আগেই এখানে আমার সামনেই বসে ছিলেন।
আমি বুঝতে পারছি এরপরও আপনাদের মনে প্রশ্ন কেন আমি এই কুড়িটি বছর আমার বাবার মুখে ঐ ডাকটি শুনতে পাই নি। আমারও একই প্রশ্ন। কেন? আমি এখনও মাঝে মাঝে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াই।
আমার ছোট মেয়েটির নাম বর্ষা। খুব চটপটে, ক্লাশ ফোর এ পড়ে। আমার যখন মন খারাপ হয়, ও আমার পাশে এসে বসে, আমাকে আদর করে, আর বলে মা তোমার কষ্টের কথাগুলো লিখে ফেল। তাহলে তোমার কষ্ট অনেক কমে যাবে।
কথাটা কিন্তু ও মন্দ বলে নি। আমি এরপর থেকে একটু একটু করে আমার কষ্ট গুলো লিখে ফেলার চেষ্টা করি এবং অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করি। প্রথমদিকে লেখালেখি একটু কঠিন মনে হলেও এখন বলতে পারেন লেখালেখিটা আমার কাছে ভাল থাকার ঔষধে পরিণত হয়েছে।
মাঝে মাঝে স্মৃতির গভীরে ঢুকে ঘটনা গুলো লিখতে খুব কষ্ট হয়। বুকে চাপা কান্না অনুভুত হয় তারপরও চেষ্টা করি স্মৃতিগুলো হাতড়ে বের করে আনতে। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর আজও আমি খুঁজে পাই নি। কি ছিল আমার দোষ?
আমার বয়স তখন পাঁচ। সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। প্রায়ই মা বাবার মাঝে ঝগড়া হত। আমি ছোট ছিলাম বলে ঝগড়ার বিষয়বস্তু ঠিক বুঝতে পারতাম না।
এই ঝগড়ার সময় সামনে থাকলে আমাকেও বকা দেওয়া হত। মা আমাকে প্রায়ই বকত। বাবা এটা নিয়ে কিছু বলতে গেলে মা আরও রেগে যেত।
ঝগড়ার এক পর্যায়ে মা প্রায়ই বাবাকে বলত “আমি চাই তুমি এই বাসা থেকে বের হয়ে যাও আর কোনদিন ফিরে আসবে না।”
একদিন সত্যি সত্যিই বাবাকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে হল।
বাবা বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম “বাবা কোথায়?” মা চিৎকার করে বললেন সে আমাদের জীবনে আর নেই... আর কোনদিন এই প্রশ্ন আমাকে করবে না।"
আমি সত্যিই আর কোনদিন মাকে এই ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করি নি।
আমার নানা নানী (আমার মায়ের বাবা মা ) আমাদের পাশের বাসাতেই থাকতেন। আমি আমার মায়ের রোষানল থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য নানা নানী-র কাছে গেলাম একটু সহানুভুতি পাওয়ার আশায়।
আমি কেঁদে কেঁদে তাদেরকে সম্পুর্ণ ঘটনাটি বললাম। কিন্তু আমি জানতাম না আমার সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
আমার নানী আমাকে বললেন, “তুমি কেঁদো না... তোমার মার কথা শোন... বাবার কথা ভুলে যাও... তোমার মা তোমার জন্য আরো একজন বাবা নিয়ে আসবে।”
আমাকে আমার বাবা ছাড়া থাকতে হবে এটা আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারি নি। আমি যখন বড় হতে লাগলাম আমি বাবাকে খুব মিস করতাম।
বাবা আমার স্কুলের কোন প্রোগ্রামে আসত না, আমার সাথে ছুটির দিন বা জন্মদিন গুলো কাটাতো না।
যখন আমার বয়সের অন্য কোন বাচ্চাকে দেখতাম বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে বা বাবার সাথে খেলা করছে তখন সবচেয়ে বেশী কষ্ট হত আমার। কিন্তু মার ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না।
বাবা বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার তিন সপ্তাহ পর আমাদের বাসায় নতুন এক মুখ আবিষ্কার করলাম। আমার মা বললেন এই তোমার নতুন বাবা। আমি মা কে কিছুই বললাম না।
তবে মনে মনে বললাম, আমার তো বাবা আছেই। আমার নুতন বাবার কোন প্রয়োজন নেই।
আমি আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম বাসার পরিবেশ আমার জন্য অসহ্য হয়ে উঠছে। আমার বাবা হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নুতন এই লোকটিকে আমি কোনভাবেই সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না।
ঐ নতুন লোকটি আসার পর থেকে মা এর সাথে আমার দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। মাকেও আমার কাছে অসহ্য মনে হত।
আমি প্রায়ই আমার নানা নানির বাসায় ছুটে যেতাম একটু শান্তির আশায়। বাবা কোথায় আছে জানার জন্য। কিন্তু তারা আমার বাবার ব্যাপারে কোন কিছুই বলত না। নানীর মুখে শুধু একই কথা "বাবাকে ভুলে যেতে হবে।"
ঐ এতটুকু বয়সে বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমি আর কিই বা করতে পারতাম? তবে আমার মনে একটা আশা ছিল... আমি বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন ঠিকই পেয়ে যাব।
আমি দিন দিন বড় হতে লাগলাম। প্রতিদিন সকালে উঠেই বাবার ডাক শুনতে পেতাম। কল্পনায় আমার বাবা সব সময় আমার সাথে থাকতেন। আমি ছাড়া বাবাকে আর কেউ দেখতে পেত না।
বাবাকে নিয়ে আমি আমার এক কল্পনার জগত তৈরি করে নিয়েছিলাম। আমার কষ্ট হলেই কল্পনার জগতে চলে যেতাম বাবাকে সব বলতাম। বাবা সবসময় আমার পাশে পাশে থাকতেন আমার দুঃখ কষ্ট গুলো বহন করার জন্য।
আমি তখন বেশ বড় হয়েছি। কিন্তু মজার বিষয় হল, কল্পনার রাজ্যে আমার বাবার বয়স আমার পাঁচ বছর বয়সে যেমনটি দেখেছিলাম অবিকল সেই রকমই ছিল।
আমি অনুভব করতাম বাস্তব জগতে বাবা বেঁচে আছে, এবং আমার খুব কাছাকাছি আছে। আমার সাথে একদিন তার দেখা হবে এই জন্য সে দূরে কোথাও যায় নি।
আমি একদিন বড় হবে এবং সেদিন নিজে থেকেই তার কাছে যেতে পারবে সেই আশায় আমার বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবো তখন যে ভাবেই হোক আমার বাবাকে খুঁজে বের করবই।
দেখতে দেখতে আমি আমার নিজের ইচ্ছায় চলাচলের যোগ্য হয়ে উঠলাম। আমি একটি চাকুরিতে যোগ দিলাম। একটি ছোট বাসা নিলাম। বাবার এক বন্ধুর সহযোগিতায় বাবাকে খুঁজে বের করলাম এবং আমার কাছে নিয়ে আসলাম।
এরপর আমার বিয়ে হল। একে একে আমার দুটি সন্তান হল। বাবা এখন আমার সন্তান দুটিকে নিয়ে বেশ ভাল আছেন।
শৈশবে বাবার যে আদর থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি সে কষ্ট আমি এখনও ভুলতে পারি না। বাবাকে যখন আমার সন্তানদের সাথে খেলাধুলা করতে দেখি, তখন কল্পনার রাজ্যে বাবাকে নিয়ে আমার খেলাধুলার স্মৃতি গুলো মনে পড়ে।
বাবাকে ঠিকই কাছে আনতে পেরেছি, কিন্তু মেঘ বালিকা ডাকটি শোনার সৌভাগ্য আমার আর হয় নি। কারণ মেঘ বালিকা নামটি তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে এখন বাবা শুধু হাসে আর কান্নাকাটি করে।
অনেকে উপদেশ দেন অতীত ভুলে যাও, বর্তমান নিয়ে চিন্তা কর এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাও। আমার জীবনের ঘটনা গুলো অতীত তারপরও আমি শেয়ার করলাম ...
যেন মা বাবাদের নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা, মুক্তচিন্তা বা অধিকার আদায়ের নামে আর কোন মেঘ বালিকাকে বলি হতে না হয়। যেন কাগজ কলমের উপর ভর করে শৈশবের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে না হয় আর কোন মেঘ বালিকাকে।
যদি নিজেদের আনন্দ, উন্নতি, মুক্তচিন্তা এবং
অধিকার আদায়ই তোমাদের কাছে আমাদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন হয়, তাহলে আমাদের মত মেঘ বালিকাদের পৃথিবীতে এনে কষ্ট দেওয়ার অর্থ কি?
পাঠক এই ঘটনাটি আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মাঝে একটি সত্য ঘটনার আলোকে বর্ণিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment
Thank you for your time. I will get back to you soon.
Nathan