Sunday, May 13, 2012

মা আমার অস্তিত্বে

আজ আন্তর্জাতিক মা দিবস। ধূলির এই ধরায় আগমনের মাধ্যম ‘মা’র প্রতি বিশেষ সম্মান জানানোর একটি দিন। তবে দিবসটি কারো কারো জন্য সুখের হলেও কারো কারো জন্য কষ্ট নিয়ে আসে।  

পাঠক, মা দিবসের এই দিনে মাকে নিয়ে আবেগ নির্ভর অশ্রুসিক্ত নয়নে পড়ার মত কোন পোষ্ট লেখার অভিপ্রায় আমার নেই। বিবেকের তাড়নায় এই পোষ্টটি লিখছি।

সাধারণত প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে পালন করার রীতি অনেক দেশেই গড়ে উঠেছে। 

আসুন মা দিবসের ইতিহাসটা একটু ঝাঁলাই করে নেই:
 
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, মা দিবস পালন করার রীতি এ যুগের নয়। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগেও অনেক জায়গায় এই দিবসটি পালন করতো মানুষ।

খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই মিশর, রোম ও গ্রিসে মা দিবস পালন করা হতো। তবে তখন দেবতাদের মায়ের (যেমন দেবী আইসিস, সিবিলি, রিয়া) আরাধনা করা হত।

১৬ শতকে ইংল্যান্ডে মা দিবস পালন করা হতো বলে জানা যায়। এটাই ছিলো দেব-দেবীদের মা ছাড়া নিজের আসল মাকে নিয়ে মানে রক্ত মাংসের মাকে নিয়ে মা দিবস।

ব্রিটিশরা আমেরিকায় তাদের কলোনি স্থাপন শুরু করার পর ইংল্যান্ড থেকে দলে দলে মানুষ আমেরিকায় বসবাস করতে শুরু করে। আমেরিকার এই সব নতুন অধিবাসীরা ইংল্যান্ডের মাদারিং ডে’কেও আমেরিকায় আমদানি করে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু নানা কারণে সেটা তারা চালু রাখতে পারে না।

এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৭০ সালে আমেরিকার জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামের এক গীতিকার, মা দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের সময় এক মায়ের সন্তান আরেক মায়ের সন্তানকে হত্যা করছিলো অবলীলায় তা দেখে  হত্যা বন্ধ করার জন্য জুলিয়া আমেরিকার সব মাকে একসাথে করতে চাচ্ছিলেন।

এদিকে ভার্জিনিয়ার একটি মহিলাদের দল জুলিয়া ওয়ার্ড হাও-এর প্রস্তাবিত মা দিবসটি পালন করতো বেশ মর্যাদার সঙ্গেই। এই দলের নেত্রী ছিলেন অ্যানা রিভেস জারভিস। তিনি গৃহযুদ্ধের সময়কালে ‘মাদার’স ফেন্ডসিপ ডে’ পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই দিবসের পালনের কারণে গৃহযুদ্ধ সময়কালে অনেকটাই শান্তির বার্তা এনে দিয়েছিলো। 

অ্যানা রিভেস জারভিস এর মৃত্যুর পর তার মেয়ে অ্যানা এম জারভিস মা দিবস ঘোষণা আন্দোলনের হাল ধরে। অ্যানা জীবিত ও মৃত সব মায়ের প্রতি সন্মান জানানোর তথা শান্তির জন্য এই দিবসটি পালন করতে চাচ্ছিলেন।

এই লক্ষ্যে তারা ১৯০৮ সালে গ্রাফটনের ওই গির্জার সুপারিনটেনডেন্টের কাছে একটি আবেদন জানায়। তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে সে বছরই ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ও পেনসিলভেনিয়ার কয়েকটি গির্জায় মা দিবস পালিত হয়। এভাবে অনেকেই প্রতিবছরই মা দিবস পালন করতে শুরু করে।

এরপর অনেক পথ পেরিয়ে ১৯১৪ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে জাতীয় মা দিবসের মর্যাদা দেয়।

আরও পরে ১৯৬২ সালে এই দিবসটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
 



ইতিহাস নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি হল। এবার একটা গল্প শুনুন...

গল্পটি আমাদের অতি চেনা মাকড়শাকে নিয়ে। মাকড়শার কথা শুনে অনেকেই ভয় পেয়ে গিয়েছেন মনে হচ্ছে! এটি ঠিক গল্প নয়, একেবারে সত্যি ঘটনা। আমরা জানি মাকড়শার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মা মাকড়শা সেই ডিম নিজের দেহে বহন করে বাচ্চা বের না হওয়া পর্যন্ত। প্রকৃতির নিয়মে একসময় ডিম ফুটতে শুরু করে। নতুন প্রাণের স্পন্দন দেখা যায় ডিমের ভেতর। কিন্তু খাদ্য কোথায়? ক্ষুধার জ্বালায় ছোট ছোট মাকড়শা বাচ্চারা মায়ের দেহই খেতে শুরু করে ঠুকরে ঠুকরে। সন্তানদের মুখ চেয়ে মা নীরবে হজম করে সব কষ্ট, সব যন্ত্রনা। একসময় মায়ের পুরো দেহই চলে যায় সন্তানদের পেটে। মৃত মা পড়ে থাকে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে, সন্তানেরা নতুন পৃথিবীর দিকে হাঁটতে থাকে। এই হলো মাকড়শা মায়ের আত্মত্যাগের কাহিনী।


মায়েরা সন্তান জন্মের আগ থেকে পুরো জীবন সন্তানের জন্য যেভাবে উৎসর্গ করেন এসব কিছুর জন্য তিনি কখনো কোন প্রতিদানের আশা করেন না। তিনি নিঃশর্ত ভাবেই নিজের সন্তানকে ভালোবেসে যান।

আমরা আমাদের জীবদ্দশায় সাধারণতঃ দু'জনকে মা ডাকার সুযোগ পাই। এক মায়ের সাথে থাকে নাড়ির বন্ধন এবং আরেকজনের সাথে থাকে সামাজিক বন্ধন। অবশ্য অনেকে ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমী চিত্রও পাওয়া যায়।

আমিও দু’জনকে মা ডাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমার নাড়ির বন্ধনে প্রাপ্ত মা সুপ্রিতী সরকার এখনও আমার পাশে আছেন, আর সামজিক বন্ধনে প্রাপ্ত মা অশ্রুকণা দাস পরলোক গমন করেছেন।

না পাঠক আমার মায়েদেরকে নিয়ে আমি কিছু লিখব না। সবার কাছেই মা শ্রেষ্ঠ। মা দিবস তো একটা প্রতীকি দিন। আমার কাছে ৩৬৫ দিন নয় যতদিন বেঁচে থাকব প্রতিদিনই মা দিবস।
 

আমার কাছে কোন বিশেষ দিবস মানে হচ্ছে এক ধরণের রিমাইণ্ডার বা কোনকিছু স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি দিন। 

অনেকে এই সব কৃত্রিম দিবস গুলোর বিরোধী। তাদের যুক্তি হচ্ছে পুঁজিবাদি দেশ গুলো ব্যবসার উদ্দেশ্যে এই সব দিবসের আবিস্কার করেছে। কারণ মা দিবসে বিদেশে নাকি সবচেয়ে বেশি টেলিফোন কল হয়। ভালবাসা দিবসে সবচেয়ে বেশি ফুল কিংবা উপহার বিক্রি হয়। ইহা কি এক ধরনের ব্যাবসার ফন্দি নয়?

তবে আমার মতে মায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য একটি দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

কারণ আমিত্ব আমাদেরকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে "মাকে ছাড়া আমরা অস্তিত্বহীন" এই কথাটি আমরা ভুলে যাই।

যুগে যুগে মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ পাল্টে যাচ্ছে। ভেতরের চেয়ে বাহির বড় হয়ে উঠছে!

Virtual reality-র এই যুগে ভেতরের চেয়ে বাহির দিন দিন বড় হওয়ার ফলে আমাদের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়া অসম্ভব কিছু নয়। আপনার আশে পাশে তাকিয়ে দেখুন আমিত্ব এবং স্বার্থপরতার ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখতে পাবেন।

মা অসুস্থ হয়েছে, ওষুধটা পর্যন্ত এনে দিই না। বৃদ্ধ হয়েছে, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিই। একটি ফোন করে খোঁজখবর নেওয়ার সময় আমাদের নেই। অথচ এই মানুষটা কী চান আমাদের কাছে? শুধু একটু ভালবাসা। তার চাহিদা আমাদের মতো এত বড় নয়। তিনি প্রতিদান চান না, তিনি প্রাপ্য চান না, অধিকার নিয়ে কোনো কথা বলেন না তিনি। শুধু একটু মায়া চান। তাও কি আমরা দিতে পারি না!

পরিশেষে যার লেখনিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আজকের এই লেখাটি লিখলাম, তার একটি লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করে আমার লেখাটি শেষ করছি:

"সেদিন বড় কষ্ট বুকে চেপে এক মা বলছিলেন, ‘জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল আমার। বাসায় কেউ নাই। বমি করছি বারবার, ছেলে আমার পাশের ঘরে কম্পিউটারে কী যেন করে। ডাকি, আসে না। পরে ওর কাছেই শুনলাম, ও নাকি ফেসবুকে আমার অসুস্থতা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ওর মনের অবস্থা ভাগাভাগি করছিল!"...



এই লেখাটিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সুমনা শারমিন কে ধন্যবাদ।

No comments:

Post a Comment

Thank you for your time. I will get back to you soon.
Nathan