Tuesday, April 24, 2012

অধিকার? নাকি দায়িত্ববোধ+অধিকার?


মানবাধিকার। বিশ্বব্যাপী বেশ আলোচিত একটি শব্দ।
এই অধিকার কতটুকু অর্জিত হয়েছে এই পর্যন্ত?

আমাদের সমাজ প্রতিনিয়ত আত্মকেন্দ্রিক এবং বিপদজ্জক হয়ে উঠছে। মানুষ অশান্ত হয়ে উঠছে দিনের পর দিন।

মানুষের অধিকার সুনিশ্চত করা অবশ্যই প্রয়োজন।

কিন্তু যখন কোন অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ফলে  সমাজের এক অংশের দাবী পুরণ হলেও অন্য একটি অংশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক সেই অধিকার নিয়ে। আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি উদাহরন তুলে ধরছি।    

উদাহরন ১:
লিভ টুগেদার এখন অনেক দেশেই মানুষের অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বা পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা জানি লিভ টুগেদার এর ক্ষেত্রে কোন ফরমালিটির প্রয়োজন পড়ে না যা গতানুগতিক বিবাহের ক্ষেত্রে অত্যাবশকীয়।

কিন্তু তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করে দেখা গিয়েছে যে, লিভ টুগেদার এর নেতিবাচক প্রভাবের ফলে, single parenthood, deprived childhood এবং dependence on welfare বেড়ে গেছে আশংকাজনক হারে।

শিশুরা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পরিবেশ হারাচ্ছে। এছাড়াও সরকারের ওয়েলফেয়ার বাজেটের উপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। আর এই ওয়েলফেয়ার বাজেটের টাকা আসে গতানুগতিক মধ্য আয়ের পরিবার (Two-parent family) গুলোর ট্যাক্স থেকে।  

সিংগেল প্যারেন্টহুড যার যার ব্যক্তিগত অধিকার এবং পছন্দ। কিন্তু তাদের এই নিজস্ব ইচ্ছাপূরনের ব্যয় বহন করতে হচ্ছে অন্যকে।

উদাহরন ২:
Rights of individuals to live homosexual lifestyles অনেক দেশ এটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে বা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে এটি পাপ। যা ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা ও সামাজিক রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়।

উদাহরন ৩:
নারীদের right to terminate an unwanted pregnancy অন্যদিকে right of the unborn to live বিপরীতমুখি।

উদাহরন ৪:
বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেশীয় আইন অনুযায়ি স্বীকৃত হলেও বিভিন্ন ধর্মীয় আইন (যেমন: খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ) অনুযায়ী স্বীকৃত নয়। আমাদের সমাজে Marital Infidelity, adultery এবং extramarital affair-এর ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে আশংকাজনক হারে। এই সব অবিশ্বস্ত কাজে জড়িত প্রতারকেরা বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারের সুযোগ নিয়ে নিজের দায়িত্ববোধের কথা ভুলে গিয়ে উন্মুক্ত মানসিকতার লেবাস লাগিয়ে নিজের অন্যায় ইচ্ছা পূরন করে যাচ্ছে। তবে এটাও ঠিক কিছু ক্ষেত্রে এই বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার গুরত্বপূর্ন ভূমিকা রাখছে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে এই বিপরীতমুখি অধিকার গুলো নিশ্চিত করা হবে বা এই অধিকার গুলোর সব গুলোই কি অত্যাবশকীয়? আমি কোন তর্কযুদ্ধে যেতে চাই না।    

মানুষের চাহিদার শেষ নেই। এই সমস্যা উত্তরনের ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব দায়িত্ববোধ একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। দায়িত্ববোধ বলতে খুব সাধারন ভাবে আমরা বুঝি “আমার সম অধিকার যেন অন্যরাও পায় তা নিশ্চিত করা”। ব্যক্তিগত পছন্দের জীবন যাপন করতে গিয়ে অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন না করা। যদিও দায়িত্ববোধ এর সংগা আরও ব্যাপক।

মূল্যবোধ মানুষের মাঝে দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিজীবনে মানুষের কাজকে প্রভাবিত করে তার মূল্যবোধ

কিন্তু আজ সমাজের যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়। মূল্যবোধহীন সমাজ আত্মকেন্দ্রিক মূল্যবোধ বিবর্জিত অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ব্যস্ত। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সমাজে বিশৃঙ্খলা ও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। 

সামাজিক ন্যায়বিচার, শৃঙ্খলাবোধ, সহনশীলতা, শ্রমের মর্যাদা, সহমর্মিতা, আইনের শাসন প্রভৃতি সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তি।

বৈজ্ঞানিক যুক্তি দ্বারা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত নয়। সামাজিক মূল্যবোধের কতগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন, মূল্যবোধের মূল হল ভিত্তি মানসিক ধ্যান-ধারণা, আদর্শাবলি ও নৈতিকতা।

সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র রচনা করে এবং সমাজ জীবনে গতিশীলতা আনে। মূল্যবোধ সামাজিক প্রয়োজন পূরণের উপায় হিসেবে কাজ করে। সামাজিক মূল্যবোধ যেমন মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধের সৃষ্টি করে, তেমনি মানুষকে অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়, বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সমাজের মানুষ মূল্যবোধ সম্পর্কে পরিচিত হয়। ব্যক্তিগত মূল্যবোধগুলোর একত্রিত রূপ হল সামাজিক মূল্যবোধ।






মূল্যবোধ সমাজ থেকে উদ্ভূত, প্রাকৃতিক নয়। ইতিবাচক সামাজিক মূল্যবোধ জাতীয় বিবেককে জাগ্রত করে এবং সহমর্মিতার অনুভূতি দান করে প্রত্যেকের সহানুভূতি ও মমত্ববোধ জাতীয় বন্ধনকে সুদৃঢ় করার মাধ্যমে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তা করে।
সামাজিক মূল্যবোধ নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি সৃষ্টি করে। মূল্যবোধ মানুষের আচরণবিধি প্রণয়ন করে সমাজের স্বার্থে মানুষের আচার-ব্যবহারকে বাঞ্ছিত খাতে পরিচালিত করে এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে ও ব্যক্তির পরিপূর্ণতা অর্জনে সহায়তা করে।
যে মূল্যবোধগুলো ইতিবাচক, যেগুলো আমাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, জাতিসত্তাকে সমুন্নত রাখতে অবদান রাখছে। বাইরের মূল্যবোধের ছোঁয়া আমাদের গায়ে লাগবে কিন্তু তাতে যেন আমরা আক্রান্ত না হই, নিজেদের অস্তিত্বকে বিলীন করে না দিই, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক
মূল্যবোধ গঠনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোর গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত করে ফেলছে বা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

তাছাড়া নতুন প্রজন্ম এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোর প্রতি আকর্ষন হারিয়ে ফেলছে। যুগে যুগে সমাজের মুল্যবোধ গঠনে এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে এসেছে।

আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস, বেহিসাবী জীবনযাপন আমাদের মুল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। আমরা এখন এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে শুধু একটি বিষয়েরই প্রাধান্য আর তা হল আমি কি পেলাম বা পেয়েছি বা পাইনি। অন্যদের ব্যাপারে চিন্তা করার সময় নেই আমাদের। মূল্যবোধ বিবর্জিত অধিকার আদায়ে ব্যস্ত সবাই।

আমরা যদি একটু পিছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সম্পুর্ন ভিন্ন চিত্র। মানুষ তখন সামাজিক জীব হিসাবে বসবাস করত আর আমরা ধীরে ধীরে হচ্ছি অসামাজিক। তখন মানুষ একে অন্যের প্রতি যে দায়িত্ব অনুভব করত এখন আর তা দেখা যায় না।

আসুন আমরা শুধু নিজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট না থেকে একটু দায়িত্ববান হওয়ার চেষ্টা করি। নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে গিয়ে অন্যের কোন অন্যায় কাজ কে প্রশ্রয় না দেই। অন্যদের অধিকার গুলোকে সম্মান করতে শিখি। নিজেদের হীন স্বার্থ সিদ্ধির পাপ পথ থেকে ফিরে এসে সুপথে চলি। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি  সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাজ গঠনে সচেষ্ট হই।

কিডনি ছাড়া যেমন কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না তেমনি কিডনি নামক মূল্যবোধ ছাড়াও সমাজ বাঁচে না। কিডনি হওয়া চাই সুস্থ, সবল ও কার্যকরী। তবেই প্রাণী এবং সমাজে সুস্থতা এবং পরিচ্ছন্নতা বিরাজ করবে। ব্যক্তি, দল, সমষ্টি সমাজ তথা আমাদের সকলের দায়িত্ব হল আমাদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা।

No comments:

Post a Comment

Thank you for your time. I will get back to you soon.
Nathan